বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১১

 পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ এখন আইনি সীমার মধ্যে

পুঁজিবাজারে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ গত জুন শেষে দাঁড়িয়েছে তাদের মোট আমানতের ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১৫ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, শেয়ারবাজারে একটি বাদে সব ব্যাংকের বিনিয়োগই ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে রয়েছে। যে ব্যাংকটির বিনিয়োগ ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি রয়েছে, তা একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শেয়ারে বিনিয়োগের কারণেই বেশি হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
উপরন্তু, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হাতে থাকার কারণে এই বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ধরনের সম্মতিও রয়েছে বলে জানা যায়।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬(২) ধারা অনুসারে, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের সমষ্টিগত বিনিয়োগ মোট দায়ের (আমানত) ১০ ভাগের বেশি হতে পারবে না, যদিও যেসব ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের সবারই ইতিমধ্যে সাবসিডিয়ারি বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছে। ফলে ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এখন পৃথক সত্তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে এই সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব হবে একক কোম্পানিতে বিতরণ করা ঋণসীমার বিধান দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুসারে, একক কোম্পানিতে ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। তা সত্ত্বেও ব্যাংক কোম্পানির আইন ও শেয়ারের সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ-ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সময়ভিত্তিতে নজরদারির মধ্যে রেখেছে।
বর্তমানে শেয়ারবাজার অনেকটাই নিম্নমুখী থাকায় তথা বিভিন্ন শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় তা ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকে আইনি সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ ও ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজার যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে, তখন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আইনি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা চালায়। ২০০৮ সালের শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে উদ্যোগ নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো সে সময় জানায়, তাদের উদ্দেশ্য ছিল শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্টতা আইনি সীমার মধ্যে রাখা। কিন্তু, এসব তথ্য-উপাত্ত চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর ২০০৯ সালের মধ্যভাগে এসে রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আইনি সীমার মধ্যে রাখতে বাধ্য করাতে পারেনি।
সে সময় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ডিএসইর ত ৎ কালীন সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন।
আবার ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রতিদিন বাজারমূল্যের ভিত্তিতে (মার্ক টু মার্কেট) হবে, না শেয়ার কেনার মূল্যে হবে, এ নিয়েও পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।
উচ্চমূল্যের সময় এসইসি ও ডিএসইর নেতৃত্ব চেয়েছেন শেয়ার ক্রয়মূল্যে ব্যাংকের বিনিয়োগ ধরে রাখতে। তাতে বাজারকেও উচ্চমাত্রায় ধরে রাখা সম্ভব হবে—এমনটিই মত দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বাজারমূল্যে বিনিয়োগের হিসাব করার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। এতে বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের যে শর্ত নিহিত আছে তাও নিশ্চিত হয়।
তা ছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের দায়িত্ব হলো শেয়ারের সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে দাম পড়তে থাকলে ক্রয় করে বাজার স্থিতিশীল পর্যায়ে ধরে রাখা। আবার যখন বাজার উচ্চমাত্রায় বা অতিমূল্যায়িত পর্যায়ে উঠবে, তখন প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে চাহিদার বিপরীতে জোগান বাড়াবে। তাতে বাজার একটি পর্যায়ে স্থিতিশীল হবে।
‘মার্ক টু মার্কেট’ ধরে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব করা হলে আইনি শর্ত মানতে গিয়েই দাম বাড়ার কারণে তাদের বিনিয়োগসীমা (দায়ের ১০ শতাংশ) অতিক্রম হতে যাচ্ছে—এমন বিবেচনাতেই শেয়ার বিক্রি করতে ব্যাংকগুলো বাধ্য হবে। এতে বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়বে। ফলে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে জোগান বাড়ানো যাবে। তাতে দাম স্থিতিশীল হবে।
বিপরীত দিকে, যখন দাম কমে যাবে তখন ব্যাংকের বিনিয়োগসীমায় নতুন সুযোগ তৈরি হবে পুনর্বিনিয়োগের। ফলে ব্যাংক তখন শেয়ার কিনলে নিম্নগামী বাজারের মূল্যপতন আটকানো যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিধানের মধ্যে থেকেই এখন ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলে নতুনভাবে শেয়ার ক্রয় করতে পারে, যদিও সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হওয়ায় এখন এই আইনি সীমায় নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।
তবে একই সঙ্গে দেখতে হবে, ব্যাংকগুলো তাদের এই বিনিয়োগ সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে যে ঋণ দিয়েছে তার পরিমাণ একক গ্রহীতাকে দেওয়া ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে কি না।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৪৩টি ব্যাংকের জুন পর্যন্ত শেয়ারবাজারে নিজস্ব বিনিয়োগ রয়েছে নয় হাজার ৬১০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার। সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ চার হাজার ২০৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য অন্যদের ঋণ দেওয়া আছে এক হাজার ২৯২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার।
এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের পরিমাণ ছিল চার লাখ ২৯ হাজার ৪৫৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন